মুসলমানদের বিরুদ্ধে কেন হঠাৎ আক্রমণ শুরু করলেন মোদি

মুসলমানদের বিরুদ্ধে কেন হঠাৎ আক্রমণ শুরু করলেন মোদি

ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে সাত দফায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার ত্রাণকর্তা হিসেবে নির্বাচনে লড়ার কৌশল বেছে নিয়েছেন। এটা স্পষ্ট করা হয়েছে, হিন্দুদের স্বার্থের সুরক্ষা মানে মুসলমানদের কাছ থেকে তাঁদের সুরক্ষিত রাখা।

মোদি ও বিজেপির মতে, মুসলমানদের সঙ্গে মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বিরোধী দল কংগ্রেস। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো হিন্দুদের সম্পদ ও অধিকার কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়া। এ জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে হিন্দুরা বিপদের মুখে রয়েছেন।

মোদি স্পষ্টত একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছেন। নির্বাচনকে হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। আর বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে দলটিকে ‘হিন্দুদের দল’ বলছেন। মোদির বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই বোঝা যায়, তিনি শুধু হিন্দুদের বিজেপির ভোটার হিসেবে ভাবছেন। দলের অন্য নেতারাও এমনটাই ভাবছেন।

নরেন্দ্র মোদি গত রোববার রাজস্থান রাজ্যে একটি নির্বাচনী সমাবেশে বলেছিলেন, ‘যদি বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে নেবে। যাঁদের বেশি সন্তান রয়েছে, তাঁদের সেই সম্পত্তি দিয়ে দেবে।’ স্পষ্টতই মুসলিমদের প্রতি ইঙ্গিত করে এ মন্তব্য করেন মোদি। তিনি মুসলমানদের ভারতীয় ভূখণ্ডে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলেও অভিহিত করেন।

প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য ভারতে অনেকের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মোদির মন্তব্যকে ‘ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য’ হিসেবে উল্লেখ করে ভারতজুড়ে অনেক নাগরিক ও অধিকার সংগঠন তাঁর (মোদির) বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আবেদন জানিয়েছে।

অধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজ বলছে, প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার জন্য নরেন্দ্র মোদিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

এত বিতর্ক-সমালোচনা মোদিকে দমাতে পারেনি। দুদিন পর গত মঙ্গলবার রাজস্থান রাজ্যে আরেকটি নির্বাচনী সমাবেশে মোদি আবারও দাবি করেন, কংগ্রেস ভারতজুড়ে হিন্দুদের সম্পত্তি হস্তগত করা ও সেসব ‘নির্ধারিত’ মানুষের মধ্যে বিতরণ করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে।

শুধু কি তা-ই, মোদি আরও অভিযোগ করেছেন, কংগ্রেস শিক্ষা, চাকরি, সরকারি প্রকল্প থেকে অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতিগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত কোটা কেড়ে নেবে। সেসব কোটা দেওয়া হবে মুসলমানদের। এর মধ্য দিয়ে মোদি স্পষ্টত পিছিয়ে পড়া হিন্দু ও দলিতদের ভোট বিজেপির বাক্সে টানার চেষ্টা করেছেন।

মোদি ও বিজেপির এমন আচরণ ও প্রচার কৌশল স্পষ্টত ভারতের নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। কেননা এতে ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোটারদের বিভাজন, ভোট চাওয়া বা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। প্রচারে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ভারতের গণপ্রতিনিধি আইনেরও লঙ্ঘন। এতে দোষী সাব্যস্ত হলে যে কারও সর্বোচ্চ ৬ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

মোদি একাই নন, গত মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস ভারতে ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যোগীর এমন মন্তব্য ছিল ভারতে ইসলামীকরণের ভীতি জাগানোর একটি সুস্পষ্ট অপচেষ্টা।

বিজেপি নেতা মোদি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি তাঁর বক্তব্যে ‘মুসলমান’ শব্দটি একবারও উচ্চারণ করেন না। কিন্তু এরপরও তিনি মুসলিমদের চরম অবমাননা, উপহাস ও আক্রমণ করতে সিদ্ধহস্ত। উদাহরণ হিসেবে ২০০২ সালের ঘটনা বলা যেতে পারে। তখন মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। ভয়ংকর দাঙ্গায় গুজরাটে হাজারো মুসলমান ঘরবাড়ি হারান। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।ওই সময় মুসলমানদের আশ্রয় নেওয়া শিবিরগুলো একে একে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে মোদির রাজ্য সরকার। দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচনা হয়। মোদি কটাক্ষ করে বলেছিলেন, তিনি ‘শিশু উৎপাদনকারী কারখানা’ চালু রাখার অনুমতি দিতে পারেন না।

মুসলমান শব্দটি একবারের জন্যও উচ্চারণ না করে মোদি বলেছিলেন, এঁরা এমন মানুষ, যাঁদের উদ্দেশ্য (মোটো) “আমরা ৫ জন, আর আমাদের হবে আরও ২৫ জন।” মুসলিম পুরুষদের চারটি বিয়ে করা ও ২৫ জন সন্তান নেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে মোদি এমন ব্যঙ্গ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

গত রোববার রাজস্থানের বক্তব্যেও মোদি মুসলমানদের ‘যাঁরা অধিক সন্তান জন্ম দেন’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে কটাক্ষ করেছেন।

এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ডামাডোলে মোদি একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় মুসলমানরা বাইরে থেকে এসেছেন। এখন তাঁরা অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছেন।

মোদি স্পষ্টত একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছেন। নির্বাচনকে হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। আর বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে দলটিকে ‘হিন্দুদের দল’ বলছেন। মোদির বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই বোঝা যায়, তিনি শুধু হিন্দুদের বিজেপির ভোটার হিসেবে ভাবছেন। দলের অন্য নেতারাও এমনটাই ভাবছেন।

গত বছর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি স্থানীয় বাংলাভাষী মুসলমান ভোটারদের ভোট বিজেপির বাক্সে চান না।

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটারদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পায়নি বিজেপি। এ কারণে দলটির নেতারা মরিয়া আচরণ করছেন। তাই তাঁরা পুরোনো কৌশল বেছে নিয়েছেন। আর সেটা হচ্ছে বিভাজন। মুসলমানরা ভারত দখল করে নেবে, এমন ভয় তৈরি ও হিন্দু মেরুকরণের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে বিজেপি।

কিন্তু আমরা যদি এবারের নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে মোদির বক্তব্যগুলো খেয়াল করি, তিনি একদম শুরু থেকেই বিরোধী দলগুলোকে হিন্দুবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে আসছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে মুসলিম লীগের ছাপ রয়েছে।’ ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

ভারতে ভোট

ভারতে ভোটপ্রতীকী ছবি: এএনআই

মোদি আরও দাবি করেছেন, ভারতের এখনকার বিরোধী নেতাদের চিন্তাভাবনা ১৬ থেকে ১৮ শতকে ভারত শাসন করা মুসলমান মোগলদের মতো। মোগলরা হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাছ-মাংস খেয়ে পুরো সম্প্রদায়কে অপমান করেছিলেন। মোদির মতে, এখন বিরোধী নেতারা তাঁদের নিজেদের ভোটারদের খুশি করতে একই কাজ করেন। এখানেও মোদির তির সরাসরি মুসলমানদের দিকে তাক করা। কেননা, এই ‘নিজেদের ভোটার’ মুসলমান ছাড়া আর কেই-বা হতে পারে?

মোদি ও বিজেপির এমন আচরণ ও প্রচার কৌশল স্পষ্টত ভারতের নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। কেননা, এতে ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোটারদের বিভাজন, ভোট চাওয়া বা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। প্রচারে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ভারতের গণপ্রতিনিধি আইনেরও লঙ্ঘন। এতে দোষী সাব্যস্ত হলে যে কারও সর্বোচ্চ ৬ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

এর আগেও এমন নজির ভারতবাসী দেখেছে। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনের সময় সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার চেষ্টার জন্য শিবসেনা দলের প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের ওপর ৬ বছরের নির্বাচনী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এবারের নির্বাচনে এমন অভিযোগ হরহামেশা উঠছে। জানানোর পরও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। তাই বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, কমিশন অনেক আগেই আপস করে ফেলেছে।

কেননা, গত ডিসেম্বরে বিজেপি এমন একটি আইন পাস করাতে সক্ষম হয় যে এতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি পরিবর্তনের অধিকার সংসদ সদস্যদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। আগে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এই কমিটির সদস্য ছিলেন। নতুন আইনে প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে এ দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ করা একজন মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনতা হারিয়েছে। সরকারের একটি সংস্থার মতো কমিশন আচরণ করছে। এখনকার কমিশন বিরোধী দলের নেতাদের ছোটখাটো ত্রুটি পেলেই নোটিশ দেয়। অন্যদিকে বিজেপির নেতাদের বড় বড় ভ্রান্তি নিয়েও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

এভাবে ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গেও আপস করা হয়েছে। আর ভারতবাসী মৃতপ্রায় গণতন্ত্রের জন্য নীরবে শোক করছেন।

Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে