কুয়াশা নয়, সড়কের বেহাল পরিস্থিতির কারণে উড়ছে ধুলা। দেখা যাচ্ছে না খুব কাছের জিনিসও। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট এলাকায় অবস্থিত স্ট্র্যান্ড রোডেছবি: সৌরভ দাশ
রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের বহির্বিভাগে এখন দৈনিক প্রায় ৫০০ রোগী আসছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার। জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে রোগী আসার সংখ্যা ছিল ২৫০–এর বেশি।
এই হাসপাতালে শয্যা আছে ১৫০টি। ফেব্রুয়ারি থেকে এর প্রায় কোনোটিই ফাঁকা থাকছে না।
আয়শা আক্তার বলেন, শীত চলে যাওয়ার সময় মানুষের মধ্যে হাঁচি–কাশিজনিত সমস্যাগুলো বাড়ে। ঋতু পরিবর্তনের সময় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু হাঁচি–কাশির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টের রোগী যেভাবে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এটা যে বায়ুদূষণজনিত, তা বলাই যায়।
ধুলাময় সড়কে চলছে যানবাহন। গতকাল বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধেছবি: আশরাফুল আলম
এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে জানুয়ারিতে রোগী ছিল প্রায় ৮ হাজার। আর ফেব্রুয়ারির ১৫ দিনে এ সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
ঢাকার বায়ুদূষণ বৃদ্ধির সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন ডা. আয়শা।
ঢাকার বায়ুদূষণ কমছে না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে বায়ুদূষণের গড় মান আগের সাত বছরের এই মাসের তুলনায় বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।
আমরা দেখছি ঢাকার বায়ুর মান প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। বায়ুদূষণের স্থানীয় উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এতে করে স্বাস্থ্যবিদেরাই বলছেন, দূষণজনিত অসুস্থতাও বেড়েছে।
বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ গত আট বছরের বায়ুমান সূচক বা একিউএয়ারে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্যাপস। ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের নেতৃত্বে এ গবেষণা হয়।
ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মান ছিল ২২১। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের বছরগুলোর ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় শতকরা ২ দশমিক ১৭ ভাগ বেশি ছিল। গত বছরের (২০২৩) ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুমান সূচক ছিল ২২৫ দশমিক ২। এবার তা হয়েছে ২২৫ দশমিক ৪।
বায়ুমান সূচকে ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। নম্বরের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিগুলো নির্ধারিত হয়। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। নম্বর নির্ধারিত হয় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে।
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখছি ঢাকার বায়ুর মান প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। বায়ুদূষণের স্থানীয় উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এতে করে স্বাস্থ্যবিদেরাই বলছেন, দূষণজনিত অসুস্থতাও বেড়েছে।’
বায়ুমান সূচকে ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। নম্বরের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিগুলো নির্ধারিত হয়। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। নম্বর নির্ধারিত হয় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে।
আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো শহরের নম্বর ৫০ বা তার কম হলে বায়ুর মান ভালো বলে ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’, ১০১ থেকে ১৫০ নম্বরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’, ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুর শহর হিসেবে ধরা হয়। নম্বর ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়।
নিজস্ব উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিয়ে বাইরের বায়ুকে প্রধান উৎস বলা হচ্ছে। এটা দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য যা বলে
সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জমেছে ধুলা। গাড়ি চললেই তা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিলেছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
শুধু ক্যাপসের গবেষণাই নয়, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবেও ফেব্রুয়ারি মাসে দূষণ পরিস্থিতির নিম্নমান উঠে এসেছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে দিন ছিল ২৯টি। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিদিন রাজধানীর বায়ুদূষণের চিত্র তুলে ধরে। দেখা যাচ্ছে, ২৯ দিনের মধ্যে ১৬ দিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর।
পরিবেশ অধিদপ্তর মূলত বাতাসের দূষণের উপাদানগুলোর মধ্যে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি বিবেচনা করে।
ঢাকার বায়ুদূষণ যে বাড়ছে, তা স্বীকার করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মোহাম্মাদ আবদুল মোতালিব। তবে তিনি এ ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত দূষিত বায়ুপ্রবাহ, ঢাকার দুই সিটিতে চলা নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাটের ধুলাকে মূল কারণ বলে মনে করেন।
ধুলার মধ্য দিয়ে চলাচল করতে বিপাকে মানুষ। কোনোরকমে নাক-মুখ ঢেকে চলছেন তাঁরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর দয়াগঞ্জেছবি: সাজিদ হোসেন
গত বছর মার্চে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গবেষণা ‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যায়। ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়ে আশ্রয় নেয়, যা বাংলাদেশেও দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দেয়।
আন্তসীমান্ত দূষিত বায়ুপ্রবাহ নিয়ে ২০২২ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে চার দেশের একটি আলোচনা হয়। সেখানে নেপাল ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। কিন্তু ওই আলোচনা আর এগোয়নি।
ঢাকার দূষণে আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ ও স্থানীয় উৎস—উভয়েরই অবদান আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু স্থানীয় উৎস যেমন কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের দূষণ, নির্মাণকাজের ধুলাবালি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছেন। অধ্যাপক আবদুস সালাম গতকাল প্রথম আলোকে বলছিলেন, নিজস্ব উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিয়ে বাইরের বায়ুকে প্রধান উৎস বলা হচ্ছে। এটা দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়