কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে

Nazia-ahmed

নাজিয়া আহমেদ। অনেক নামের ভিড়ে আলাদা করে হয়তো এই নামের মানুষটাকে চিনতে পারা যাবে না। কিন্তু গণমাধ্যমে দুই শিশুসন্তান আরহান আহমেদ (৭) ও আবিয়াত আহমেদের (৩) সঙ্গে নাজিয়ার ছবিটা দেখলে চেনা যেতে পারে। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনে গত বৃহস্পতিবার রাতের আগুনে যে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে নাজিয়াও আছেন। আছে তাঁর দুই শিশুসন্তান আরহান ও আবিয়াত। তাঁরা আমার আপনজন।  

সেদিন সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়ার বায়না ধরেছিল আবিয়াত। বয়সে ছোট্ট, তবু তো আবিয়াতের বড় ভাই আরহান। সে বুঝিয়েছিল বড়দের মতো করে। রোজকার মতো আবিয়াতের কপালে চুমু দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মা। কিন্তু আবিয়াত তো অবুঝ। বাসায় বাবা সায়েক আহমেদ আশিক থাকলে হয়তো সে বুঝত। বাবা বাসায় নেই, তাই বায়নাটা তার বেশি। বাধ্য হয়ে মা দুই সন্তানকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় নাজিয়া তাঁর খালাতো তিন বোনকেও সঙ্গে যাওয়ার কথা বললে, তাঁরাও রাজি হয়ে যান।

এরপর তাঁরা ছয়জন মিলে ঘুরতে ঘুরতে রাতের খাবার খেতে যান বেইলি রোডের সাততলা ভবন গ্রিন কোজি কটেজে। ঠিক কোন রেস্তোরাঁয় তাঁরা খেতে গিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না। জানি না, কারণ তাঁদের ছয়জনের কেউ-ই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। জানি না, তাঁদের ওই সময়ের আরও অনেক কথাই। এতসব না–জানা নিয়ে এখন আমাদের আয়ু অবধি পথ চলতে হবে।

গ্রিন কোজি কটেজে যখন আগুন লাগে, তখন রাত পৌনে ১০টা। স্বামী আশিককে ফোনে আগুন লাগার বিষয়টি জানিয়েছিলেন নাজিয়া। হুড়োহুড়ি করে ভবনটির নিরাপদ জায়গায় বেরও হয়ে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ দেখেন, ছোট ছেলে আবিয়াত দলছাড়া। সঙ্গে নেই। ছোট ছেলেকে ফেলে এসে কোথায় যাবেন এই মা! তাই আবারও আশিককে ফোনে বিষয়টি জানিয়ে বড় ছেলের হাত শক্ত করে ধরে ছোট ছেলেকে খুঁজতে ভেতরে চলে যান তিনি। এরপর ফোনে আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি সঙ্গে থাকা তিন খালাতো বোনকেও।

এরপর শুরু হয় উদ্ধারকাজ। ছোট্ট আবিয়াতের মরদেহ পাওয়া যায় ভবনটির তিনতলার সিঁড়িতে। এর কয়েক ঘণ্টা পর নাজিয়া ও তাঁর বড় ছেলের মরদেহ উদ্ধার হয় ভিন্ন জায়গা থেকে। তাঁদের কারও গায়ে আগুনে পোড়া ক্ষত নেই। ধারণা করা হচ্ছে, দমবন্ধ হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

আচ্ছা, মা-ভাইকে হারিয়ে ধোঁয়া আর অন্ধকারে আবিয়াত কি হৃদয়চেরা আর্তনাদ করেছিল? আমরা না জানলেও বুঝতে পারি। আরহানেরও হয়তো একই অনুভূতি হয়েছিল! নিজেকে ওই সময়ের আবিয়াত ভেবে দেখেছি, ওই ধোঁয়ায় ওই অন্ধকারে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মা, মা বলে চিৎকার করছি খুব, কিন্তু আমার চিৎকার মা শুনতে পারছে না। এমনকি কারও কানে পৌঁছাতে পারছে না ওই চিৎকার। সবাই সবার মতো ছোটাছুটি করছে। বড়দের পাশে অন্ধকারে আমি ছুটতে পারছি না। বাঁচতে চাইছে সবাই। মায়েরা বাঁচাতে চাইছে তাঁদের সন্তানদের। কিন্তু আমার মা, আমার ভাই আমার কাছে আসতে পারছে না। ধোঁয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বুকের ভেতর গুমরে উঠছে। ভয়ে মা হারানো-ভাই হারানো আমার চোখে অশ্রু, কিন্তু কান্নার শব্দ আসছে না। ধীরে, থেমে যাচ্ছে সব। হঠাৎ করে আর কিছু বলতে পারি না। মা-ও কি একইভাবে খোঁজেনি আমায়! তিনিও অন্ধকারে আমার ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে হতাশ হয়ে কাঁদেননি শেষবার! কেঁদেছেন নিশ্চয়ই। মায়ের বুকের ভেতরও নিশ্চয়ই ঢুকে পড়েছিল দ্রুতগামী রেলগাড়ির হাওয়া। আমরা আর কেউ কাউকে খুঁজে পাইনি। কিন্তু অনেক পরে সবাই আমাদের খুঁজে পেয়েছে, নিথর। আর কোনো দিন না-পাওয়ার মতো করে শেষবার খুঁজে পেয়েছে আমাদের।

Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে