খাদ্যসংকটের এদিক-ওদিক

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

খাদ্য বঞ্চনার শেষ ধাপের নাম দুর্ভিক্ষ। এখন থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে (১৮৪০) আয়ারল্যান্ডকে এক ভয়াল দুর্ভিক্ষ গ্রাস করেছিল। ‘গোল আলু দুর্ভিক্ষ’ বা পটেটো ফেমিন বলে খ্যাত ওই দুর্ভিক্ষে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল সেই দেশটি। কোনো দুর্ভিক্ষে এত মানুষ মারা গেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।

শোনা যায় যে এখনো আইরিশ জনসংখ্যা ভয়াবহ সেই দুর্ভিক্ষ-পূর্ব ১৮৪৫ সালের জনসংখ্যার চেয়ে কম। একসময় চীন, ভারত, ইথিওপিয়া, এমনকি বাংলাদেশকেও দুর্ভিক্ষের ছায়া তাড়া করত। যা হোক, আজকাল পৃথিবীর কোথাও দুর্ভিক্ষের কথা খুব একটা শোনা যায় না, এমনকি এই উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশেও। স্বীকার করতেই হবে যে আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার, যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত আয়বর্ধক কর্মসূচি মূলত দুর্ভিক্ষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

তার পরও দুর্ভিক্ষের ওপর একটু ধারণা থাকা দরকার, যেহেতু এটি খাদ্যাভাবের কফিনে শেষ পেরেক।

দুই।

প্রসঙ্গত, জর্জ বার্নার্ড শর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ থেকে একটি সংলাপ  উদ্ধৃত করা যাক। মেলনি নামের এক ধনিক আইরিশ-আমেরিকান ১৮৪০ সালের দুর্ভিক্ষকে দুর্ভিক্ষ বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ বিধায় পুত্রবধূ ভায়োলেটকে বলছেন, ‘সাতচল্লিশের কালো সময়টিতে আমার বাবা খাদ্যাভাবে মারা গেছেন।

’ ‘তার মানে দুর্ভিক্ষে?’—ভায়োলেটের প্রশ্ন। ‘না, অনাহারে। যখন একটি দেশ খাদ্যপূর্ণ ও তা রপ্তানি করছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ মেলনি উত্তর দিলেন। মেলনির খাদ্য উদ্বৃত্ত সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে তাঁর সরল মনে সম্ভবত বিশ্বাস ছিল যে দেশের ভেতর উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকলে মানুষ কখনো না খেয়ে মারা যেতে পারে না—খাদ্য উদ্বৃত্ত মানে দুর্ভিক্ষের জন্য দরজা বন্ধ।

কিন্তু শেকসপিয়ারের ‘হেমলেট’ নাটকে হেমলেটের সেই সালংকার মন্তব্য—‘স্বর্গ ও মর্ত্যে এমন আরো অনেক কিছু আছে হোরেশিও যা তোমার দর্শনের কল্পনার বাইরে’—মনে করিয়ে দেয় যে সেই সময়টিতে হয়তো মেলনির চিন্তার বাইরে অনেক কিছুই ঘটে থাকতে পারে। আসলে রূঢ় বাস্তবতা এই যে পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্য ঘাটতি নয়, বরং খাদ্য ক্রয়ে মানুষের অর্থের ঘাটতি কিংবা ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাওয়া। সুতরাং চলমান ডিসকোর্সে যে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক, তা হলো কী কী উপাদানের ওপর খাদ্যের অধিকার নির্ভর করে?
তিন।

আধুনিক বিশ্বে ক্ষুধা দূর করতে চাইলে প্রথমেই প্রয়োজন দুর্ভিক্ষের বিস্তৃত কারণ খুঁজে বের করা। শুধু খাদ্য ও জনসংখ্যার যান্ত্রিক ভারসাম্যের নিরিখে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রিকতা হচ্ছে একজন মানুষ একটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কতটুকু স্বাধীন, তা তার নিজের উৎপাদন দিয়ে হোক (যেমন কৃষক) অথবা বাজার থেকে ক্রয় করে হোক (যেমন চাকরিজীবী)। মনে রাখতে হবে যে সরবরাহের প্রাচুর্য সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি অনাহারে থাকতে বাধ্য হতে পারে যদি বাজার থেকে খাদ্য ক্রয়ে তার সামর্থ্য না থাকে অথবা সামর্থ্য হ্রাস পায়। আর যেকোনো কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে; যেমন—আয় না থাকা কিংবা উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে ব্যর্থ হওয়া। অন্যদিকে খাদ্য ঘাটতির মুখেও তেমন অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয় যদি খাদ্য আমদানি করে কিংবা ভাগাভাগি ভোগ করে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সুতরাং খাদ্যের ওপর একটি পরিবারের স্বত্বাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট (অন্য অর্থে খাদ্য নিরাপত্তা) নির্ভর করে বেশ কয়েকটি উপাদানের ওপর। প্রথমত, পরিবারটির নিয়ন্ত্রণে থাকা এমনতরো সম্পদসমষ্টি, যার বাজারে দাম আছে এবং যা বাজারে বিনিময় করে খাদ্য ক্রয় করা যায়। এই সম্পদ আবার বহুবিধ হতে পারে, কিন্তু মানবসমাজের বৃহৎ অংশের একমাত্র সম্পদ হচ্ছে শ্রমশক্তি বা লেবার পাওয়ার; যেখানে দৈহিক শ্রম বাজারে বিক্রি করে দুমুঠো খাবার পেটে দেওয়ার অবকাশ খুঁজে পায়, আর এভাবে শ্রম, জমি ও অন্যান্য সম্পদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ব্যক্তি বা খানার খাদ্য স্বত্বাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট। দ্বিতীয়ত, খাদ্যে একটি খানার কতটুকু অধিকার থাকবে, তা উৎপাদন সম্ভাবনা ও তার ব্যবহার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে প্রযুক্তির কথা—প্রাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহারের মাধ্যমে যা উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। এবং সব শেষে বিনিময় অবস্থার ওপরও খাদ্য অধিকার নির্ভর করে; যেমন—দ্রব্য বেচাকেনা ও মূল্য নির্ধারণ। অর্থাৎ কী হারে খাদ্যদ্রব্যর দামের বিপরীতে মজুরি বাড়ছে তার ওপর স্বত্বাধিকার নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক সংকটের সময় কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্যদের চেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। যেমন—১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য ও অন্যান্য বস্তুর বিনিময় হার রাতারাতি বদলে যায়, বিশেষত মাছ ও খাদ্যের আপেক্ষিক দাম। সেই সময় জেলে গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আঘাত পায়। অবশ্য মাছও এক ধরনের খাবার, তবে গুণগত খাবার এবং দরিদ্র জেলে মাছ বিক্রি করে বাঁচার জন্য প্রধান খাদ্য চাল ক্রয় করে সস্তা ক্যালরি নিতে সমর্থ হতো। তেমনি নাপিত গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দুই দিক থেকে। এক, অর্থনৈতিক সংকটের সময় সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ চুল কাটা স্থগিত করে রাখে—নাপিতের সেবার চাহিদার হ্রাস ঘটে; এবং দুই, আপেক্ষিক দামেও নাপিত পিছিয়ে পড়ে। যেমন—১৯৪৩ সালের কোনো কোনো জেলায় চুল কাটা ও খাদ্যের বিনিময় হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পড়ে যায়।

চার।

খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি হলেই কিন্তু কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় না। মনে রাখতে হবে যে একজন ব্যক্তি প্রতিদিন যতটুকু খাবার নেয়, তার প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যয় হয় শুধু দেহের তাপ, কিডনি, রক্ত সঞ্চালন, হার্টবিট, পালস ইত্যাদি আগের অবস্থায় ধরে রাখার জন্য। এটিকে বলা হয় রেসটিং মেটাবলিজম, অর্থনীতির ভাষায় ‘স্থায়ী’ খরচ। সুতরাং আয়/ভোগ বৃদ্ধি পেলেই মানুষ কর্মক্ষম হয় না। বেশ কিছু পরিমাণে খাবার গ্রহণের পরও সে কর্মোদ্দীপক না-ও হতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত রেসটিং মেটাবলিজমের শর্ত পূরণ না হয়। আবার অধিক বয়সে অতিরিক্ত খাবার হজম করার ক্ষমতা হ্রাস পায় বলে বার্ধক্যজনিত অবস্থায় অধিকতর খাদ্য গ্রহণে কর্মদক্ষতা কমে যেতে পারে।

পাঁচ।

খাদ্য নিরাপত্তার একটি অতি সহজবোধ্য সংজ্ঞা হলো, সব মানুষের জন্য একটি কর্মক্ষম এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় খাবারে সুযোগপ্রাপ্তির নাম খাদ্য নিরাপত্তা।  অর্থাৎ একটি কর্মক্ষম ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে যতটুকু খাদ্য প্রয়োজন, ততটুকু পরিমাণ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে দরকারি উপাদান হচ্ছে খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং তা অর্জন করার সক্ষমতা। খাদ্য নিরাপত্তার এই বিষয়টিকে আবার জাতীয় এবং ব্যক্তিগত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ হলো একটি দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের নিমিত্ত যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুদ রাখা, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন ফসল কিংবা আমদানির মাধ্যমে মজুদ পূরণ করা না হয়। আর ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তার মানে হচ্ছে সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য নিজস্ব উৎপাদন, বাজার অথবা সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের সুযোগ থাকা।

ছয়।

দুর্ভিক্ষের তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ও পরে (এমনকি সত্তরের দশকের শুরুতে) খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে এক ও অভিন্ন হিসাবে দেখার প্রয়াস চালানো হতো। চালের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চালের দাম স্থিতিশীল রাখার কাজটি নিঃসন্দেহে স্বয়ংসম্পূর্ণতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণ এবং রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর চোখ-ঝলসানো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্রুততর হওয়া সাপেক্ষে দেশটির খাদ্য অর্থনীতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। বলা যেতে পারে, নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্য উৎপাদন নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চেয়ে বেশি দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু তদুপরি বলা যাবে না যে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এও বলা যাবে না যে খুব দুর্বল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনসংখ্যার চাপের মুখে অর্জিত এই কৃতিত্ব ধরে রাখা যাবে। এ দেশে প্রায়ই বন্যা, খরা আর সাইক্লোনের ধাক্কায় অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে উৎপাদন ঘাটতির ঘণ্টা বাজায়। আর উৎপাদনে ঘাটতি থাকা মানেই তো অপর্যাপ্ত খাবার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যের সরবরাহে সন্তোষজনক বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু অন্যান্য খাবারের লভ্যতা বৃদ্ধি পায়নি। এখনো এ দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দৈনিক মাথাপিছু দুই হাজার ১২২ ক্যালরি গ্রহণ করতে পারছে না বলে খাদ্যনির্ভর দারিদ্র্য নির্দেশক অনুযায়ী দরিদ্র থাকছে। এরই মধ্যে অনেকটা আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার মতো সাম্প্রতিক কালে খাদ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি শিল্প ও কৃষি শ্রমিকের এবং অপ্রাতিষ্ঠনিক খাতে স্বনিয়োজিত মানুষের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে পরিস্থিতিকে নাজুক করে রেখেছে। 

Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে