করোনার সংক্রমণের পর গত তিন বছর এসএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা হয়েছিল কাটছাঁট করা পাঠ্যসূচিতে। পরীক্ষাও হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের পরে। কখনো কম নম্বরে, কখনো বিষয় কমিয়ে নেওয়া হয় এসব পরীক্ষা। তবে এবার এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে সব বিষয়ে, পূর্ণ পাঠ্যসূচিতে ও পূর্ণ নম্বরে।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার গতবারের চেয়ে বেড়েছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা ভালো ফল করেছে। ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ–৫ এর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে নয়টি বোর্ডের সঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসা বোর্ডের (এসএসসির সমমান) ফলাফল মিলিয়ে দেখলে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এবার ফল ভালো হওয়ার বড় কারণ হলো ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে প্রায় সব বোর্ডেই মোটামুটি ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা।
গত বছর (২০২৩ সাল) এসএসসির ফলাফল এর আগের বছরের চেয়ে খারাপ হয়েছিল। গত বছর পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হয়েছিল। যদিও সব বিষয়ে ও পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এবার পূর্ণ পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা দিয়েও পরীক্ষার্থীরা আগের চেয়ে ভালো করেছে।
এখন আর আগের মতো স্কুলে গিয়ে ফল জানতে হয় না। মুঠোফোনে ও অনলাইনেও নির্ধারিত কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষার ফল জানা যায়। অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ভালো ফল করার বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিতজনদের জানিয়েছেন।
গতকাল রোববার সকাল ১০টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরপর বেলা ১১টা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং অনলাইনে ফল প্রকাশ করা হয়। পরে দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। এ সময় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন নাহারসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নয়টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছর গড়ে ৮১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছিল। এর আগের বছর (২০২২ সাল) পাসের হার ছিল ৮৮ শতাংশের সামান্য বেশি। এবার জিপিএ–৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৫ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ২২০ শিক্ষার্থী।
এ বছর শুধু এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১৬ লাখ ৬ হাজার ৩৯৪ জন। পাস করেছে ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৮ জন। ফল প্রকাশের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আনন্দ উল্লাস করেছে। তবে এখন আর আগের মতো স্কুলে গিয়ে ফল জানতে হয় না। মুঠোফোনে ও অনলাইনেও নির্ধারিত কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষার ফল জানা যায়। অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ভালো ফল করার বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিতজনদের জানিয়েছেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার ফল জানতে রোববার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট থেকে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত এক ঘণ্টায় নির্ধারিত ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা (হিট) করেছেন ২৭ লাখ ১ হাজার ৭০৪ জন। আর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তিন লাখের বেশিবার ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা হয়েছে।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার প্রায় সব বোর্ডেই ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মোটামুটি ভালো ফল করেছে শিক্ষার্থীরা। যেমন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গণিত বিষয়ে এবার পাসের হার প্রায় ৮৮ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৮১ শতাংশের কিছু কম। যশোর শিক্ষা বোর্ডে গণিত বিষয়ে ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
একইভাবে ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা গতবার ছিল ঢাকায় ৯১ শতাংশ। পাসের হারে সব বোর্ডের মধ্যে এগিয়ে থাকা যশোর শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার প্রায় ৯৬ শতাংশ।
পরীক্ষার ফল জানতে রোববার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট থেকে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত এক ঘণ্টায় নির্ধারিত ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা (হিট) করেছেন ২৭ লাখ ১ হাজার ৭০৪ জন। আর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তিন লাখের বেশিবার ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর
মেয়েরা এগিয়ে
শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন ভালো করছে। এসএসসি পরীক্ষায় বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে ছাত্রীরা। এবার এসএসসি পরীক্ষাতেও পাসের হার এবং জিপিএ–৫, দুই সূচকেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো ফল করেছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যার দিক দিয়েও মেয়েরা এগিয়ে। এবার নয়টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৪৯ হাজার। তাদের মধ্যে পাসের হার ৮৫ শতাংশ। জিপিএ–৫ পেয়েছে ৮৯ হাজার ১৬৮ জন। অন্যদিকে ৭ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। পাসের হার ৮২ শতাংশের কিছু বেশি। জিপিএ–৫ পেয়েছে ৭৪ হাজার ৬৭৭ জন।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গণিত ও ইংরেজি বিষয় সব সময়ই প্রভাব ফেলে। এবার এই দুটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে, যে কারণে সার্বিক ফলও ভালো হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার
একসময় বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম ছিল। এখন বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যেমন এবার বিজ্ঞানে ছাত্র ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। ছাত্রীও প্রায় কাছাকাছি ২ লাখ ৮০ হাজারের মতো। বিজ্ঞানেও ছাত্রীদের পাসের হার বেশি।
এসএসসি ও এইচএসিতে বিজ্ঞানে ছাত্রীদের অংশগ্রহণের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষাতেও। যেমন এখন মেডিকেল কলেজগুলোতে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি।
একসময় বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম ছিল। এখন বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যেমন এবার বিজ্ঞানে ছাত্র ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। ছাত্রীও প্রায় কাছাকাছি ২ লাখ ৮০ হাজারের মতো। বিজ্ঞানেও ছাত্রীদের পাসের হার বেশি।
পাসের হারে যশোর, জিপিএ–৫ এ ঢাকা এগিয়ে
এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলে এমন আনন্দ-উল্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। ছবিটি বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তোলাছবি: জুয়েল শীল
ফলাফলের তুলনামূলক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার পাসের হারের দিক দিয়ে এগিয়ে আছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৯২ শতাংশের বেশি। জিপিএ–৫ পেয়েছে ২০ হাজার ৭৬১ জন। অন্যদিকে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর দিক দিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এগিয়ে। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার প্রায় ৮৪ শতাংশ। জিপিএ–৫ পেয়েছে ৪৯ হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী।
৫১টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দেশের ৫১টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি। এর মধ্যে মাদ্রাসা ৪২টি এবং বিদ্যালয় ৯টি। গতবার ৪৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি।
অন্যদিকে এবার ২ হাজার ৯৬৮টি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে। গতবার এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৫৪।
জিপিএ-৫ এর পাঁচ বছরের চিত্র
২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর করোনার সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয়েছিল। ওই বছর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিপিএ-৫ কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। যেমন ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৭ জন শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি। ২০২২ সালে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। গত বছর তা কমে হয় ১ লাখ ৫৯ হাজারের কিছু বেশি। এ বছর কিছুটা বেড়ে তা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৫।
দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গণিত ও ইংরেজি বিষয় সব সময়ই প্রভাব ফেলে। এবার এই দুটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে, যে কারণে সার্বিক ফলও ভালো হয়েছে।