মা-বাবার পাশের কবরে ঠাঁই হলো ফুটফুটে ফাইরুজের

Fairuj

কক্সবাজার শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যা গ্রাম। আজ রোববার সকাল থেকেই লোকজন ভিড় করছেন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক আবুল কাশেমের বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির সামনেই পরিষ্কার নিকানো উঠান। সেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে আবুল কাশেমের ছেলে শুল্ক কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন (৩৫), তাঁর স্ত্রী মেহেরুন নিসা জাহান হেলালি (২৪) ও একমাত্র মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিরা (৪)। শোকে কাতর লোকজন শেষবারের মতো তাঁদের মুখ দেখে যাচ্ছেন।

পরিবার নিয়ে ছেলে বাড়িতে এলে উৎসব লেগে যায়। আজও ছেলে পরিবার নিয়ে বাড়িতে এসেছে, কিন্তু ঘরের বাইরে নিথর শুয়ে আছে তারা। এই দৃশ্যে বুক ফেটে যাচ্ছে শাহজালালের বৃদ্ধ বাবা আবুল কাশেমের। তাঁর পাশে বসে চোখ মুছছিলেন তাঁর আরেক ছেলে শাহজালালের বড় ভাই শাহজাহান সাজু (৫২)। আজ বেলা ১১টায় মরিচ্যার গ্রামের বাড়ির আঙিনায় বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাজু বলেন, ফাইরুজ ছিল সবার আদরের। বয়স সাড়ে তিন বছর। ভাই হারানোর শোক দ্বিগুণ হয়ে গেল ফাইরুজের কারণে। কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিল ফাইরুজ। শিশু ফাইরুজের মরদেহ পরদিন শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অজ্ঞাতনামা হিসেবে পড়ে ছিল ঢাকা মেডিকেলের মর্গের মেঝেতে। মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, ধূসর রঙের হাফহাতা গেঞ্জি আর নীল পায়জামা পরা ফাইরুজ ও তার বাবা-মায়ের পরিচয় শনাক্ত করেন তার নানা মুক্তার আলম হেলালি।

স্ত্রী মেহেরুন নিসা ও একমাত্র মেয়ে ফাইরুজকে নিয়ে শুল্ক কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন থাকতেন ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কাস্টমস কোয়ার্টারে। গতকাল শনিবার রাতে তিনজনের মরদেহ  গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ার হলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যাতে নিয়ে আসেন শাহজালালের বড় ভাই শাহজাহান সাজু। তিনি হলদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

বাবা–মায়ের সঙ্গে ফাইরুজ। ছবির কেউ বেঁচে নেই এখন আর। অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিল গোটা পরিবারকেছবি : সংগৃহীত

সাজু বলেন, গত শুক্রবার রাত আটটার দিকে তিনি খবর পান আগের দিন রাতে বেইলি রোডের আগুন ট্র্যাজেডিতে যে ৪৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে তাঁর ভাই, ভাইয়ের বউ ও ভাতিজি আছে। রাতেই তিনি উখিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। গতকাল রাত ১০টার দিকে মরদেহ নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান।

আজ বেলা ১১টায় টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পূর্ব পাশে মরিচ্যা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে হাজারো মুসল্লির অংশগ্রহণে সম্পন্ন হয় আগুনে নিহত তিনজনের জানাজা। মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন শাহজালালের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ও শ্বশুর রামুর ফুতেখাঁরকুল ইউনিয়নের শ্রীকুল গ্রামের বাসিন্দা মুক্তার আলম হেলালি। নিহত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া চান তাঁরা দুজন।

জানাজা শুরুর আগে স্থানীয় হলদিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, বেইলি রোডের আগুন ট্র্যাজেডি দেশের মানুষকে শোকে স্তব্ধ করেছে। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনিকে হারিয়ে শোকে পাথর বীর মুক্তিযোদ্ধ আবুল কাশেম। আজ সকালে উখিয়ার মরিচ্যা গ্রামেছবি-প্রথম আলো

জানাজা শেষে পশ্চিম মরিচ্যা জামে মসজিদ কবরস্থানে তিনজনের মরদেহ দাফন করা হয়। প্রথমে শাহজালাল উদ্দিন, তারপর তাঁর মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিরা ও শেষে মেহেরুন নিসার দাফন সম্পন্ন হয়।

চার মাস ধরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও কার্যালয়ে শুল্ক বিভাগে কর্মরত ছিলেন শাহজালাল। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করতেন বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায়। শাহজালালের বাবা আবুল কাশেম বলেন, তিন দিনের ছুটিতে খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন তাঁর ছেলে ও ছেলের পরিবার। রাত ১১টায় তিনজনের বাসের টিকিটও কাটা হয়েছিল। রওনা দেওয়ার আগে তাঁরা তিনজন বেইলি রোডের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন।

Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে