বিভিন্ন ধর্মে কোরবানির ধরন ও দর্শন

রবিবার, ০১ জুন, ২০২৫

‘কোরবান’ শব্দটি এসেছে ‘কুরবত’ থেকে, অর্থাৎ নৈকট্য। যেকোনো বস্তু, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়, তা-ই কোরবানি। আর ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর নামে যে পশু জবাই করা হয়, তা এই আত্মিক ত্যাগের বাহ্যিক প্রতীক মাত্র। প্রকৃত ত্যাগ হলো নিজের অভ্যন্তরের কিছুকে, প্রিয়তম কিছুকে, অথবা নিজের সত্তাকেই আল্লাহর রাহে নিবেদন করা। (লিসানুল আরব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৬২, মুখতারুস সিহহা, পৃষ্ঠা-৫২৭) 

কোরবানির সূচনা ও বিভিন্ন ধর্মের ধারণা

কোরবানির ইতিহাস সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে। মানবজাতির বেশির ভাগ সম্প্রদায় ও ধর্মে কোরবানির ধারণা কোনো না কোনো রূপে বিদ্যমান। শুধু পদ্ধতি ও অনুষঙ্গের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা : আল-হাজ, আয়াত : ৩৪)

বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে কোরবানির বিষয়ে যেসব ধারণা প্রচলিত আছে, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে  ধরা হলো—

প্রথম কোরবানি
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানির উল্লেখ কোরআন মজিদে এসেছে আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের কাহিনির মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং (হে নবী) আপনি তাদের আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হয়েছিল এবং অন্যজনের কবুল হয়নি। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে বলল, আল্লাহ ধর্মভীরুদেরই কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা : আল-মায়িদাহ, আয়াত : ২৭)

তবে কোরবানির যে আত্মিক আবেগ, ত্যাগের যে দীপ্তিময় চেতনা, আত্মোৎসর্গের যে নিখাদ অনুভূতি তা পূর্ণতা লাভ করে ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর সন্তান ইসমাঈল (আ.)-এর অসামান্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে।

আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-কে এক অবর্ণনীয় পরীক্ষায় আমন্ত্রণ জানালেন—তাঁর হৃদয়ের অমূল্য রত্ন, আদরের পুত্রকে কোরবানি করার আহবান। পিতা-পুত্র উভয়েরই অন্তর আল্লাহর হুকুমের প্রতি সমর্পিত; তাঁরা নিঃশব্দে প্রস্তুত হলেন সেই মহান বিসর্জনের জন্য। কিন্তু মূলত মহান রবের উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের ঈমানি দৃঢ়তা যাচাই করা; আর এই কঠিন পরীক্ষা তাঁরা ঈমানের দীপ্তিতেই উত্তীর্ণ হলেন।
এই নিষ্কলুষ আনুগত্য ও আত্মোৎসর্গের দৃশ্য আল্লাহর দরবারে এমন নূরানি মর্যাদা পেল যে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য এই সুন্নাহকে জীবন্ত স্মৃতি হিসেবে অব্যাহত রাখলেন।

ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মে কোরবানি ও দর্শন
ইহুদি ধর্মেও পশু কোরবানির ধারণা সুস্পষ্ট; তবে তারা ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.)-এর ঐতিহাসিক কাহিনিকে ইসহাক (আ.)-এর সঙ্গে সংযুক্ত করে, এবং তারা তিনিই ‘জবিহুল্লাহ’—এই দাবি করে থাকে। তারা আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় পশু উৎসর্গ করে; আর তাদের বিশ্বাস মতে, কোনো কোরবানি কবুল হওয়ার প্রত্যক্ষ আলামত ছিল এই যে অদৃশ্য থেকে অগ্নিশিখা নেমে এসে সেই কোরবানিকে জ্বালিয়ে খাক করে দিত। বাইবেলের ভাষ্যও এই সাক্ষ্যই দেয় : প্রভুর দরবারে কোনো কোরবানি গৃহীত হলে তার নিদর্শন ছিল অন্তরাল থেকে আগুন নেমে এসে তা দগ্ধ করে দিত। (বাইবেল, কুযা (Book of Judges) ৬ : ২০-২১)

ঈসা (আ.) কোনো নতুন শরিয়তের প্রবর্তক ছিলেন না; বরং তিনি মুসা (আ.)-এর বিধান অনুসারে জীবন যাপন করতেন এবং ইহুদি শরিয়তেরই পূর্ণ অনুসারী ছিলেন। (বাইবেল : মতি, ৫:১৭)

তবে সময়ের পরিক্রমায় তাঁর পরবর্তীকালে উদিত খ্রিস্টধর্মে এক বিপুল পরিবর্তনের সূচনা হয়, যার মূলে ছিলেন সেন্ট পল (জন পল)। তিনি একাধারে দর্শন, ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে খ্রিস্টধর্মে এমন সব মতবাদ সংযোজন করেন, যা মূল তাওহিদি শিক্ষা ও নবী ঈসার প্রকৃত অনুসৃত ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপন্থী। এরই ফলস্বরূপ, কোরবানির সেই মহান স্মৃতি, যা ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মোৎসর্গ ও আনুগত্যের নিদর্শন ছিল, ধীরে ধীরে খ্রিস্টান সমাজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আজ আর খ্রিস্টধর্মে কোরবানির কোনো কার্যকর ধারা বা আনুষ্ঠানিকতা অবশিষ্ট নেই। (Paul and Jesus: How the Apostle Transformed Christianity, James D. Tabor)

হিন্দু ধর্ম ও বৈদিক যুগে কোরবানি ও দর্শন
ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্ম সবচেয়ে প্রাচীন। এই ধর্মব্যবস্থায় যজ্ঞ বা হোম (কোরবানি), দান, তপস্যা ও আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে ব্রহ্ম বা পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভকে চূড়ান্ত সিদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু দর্শনে কোরবানির মাহাত্ম্য শুধু এক দেহত্যাগে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পারলৌকিক কল্যাণ, ইচ্ছাপূরণ এবং পাপমোচনের একটি উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক চর্চা। ভাগবত পুরাণেবর্ণিত আছে : নারায়ণ সমগ্র জগৎ বিনাশের পর কেবল একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ বা ঘোড়ার কোরবানি করেই পাপমোচন করেন।
(ভাগবত পুরাণ, খণ্ড-১২, অধ্যায়-৭, শ্লোক-১৭)

বৈদিক যুগে এই কোরবানির রীতিকে কেন্দ্র করে সমাজে বহু ‘যজ্ঞান্বিত’ বধ্যভূমির (বধশালা) অস্তিত্ব ছিল। সে সময় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করত এবং উৎসর্গকৃত পশুর মাংস পারস্পরিকভাবে ভাগ করে গ্রহণ করত—এটা ছিল ধর্মীয় আচার ও সামাজিক সম্প্রীতির এক সম্মিলিত রূপ।  (Rigveda 10.85.13, Satapatha Brahmana 3.1.2.21)

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে কোরবানি ও দর্শন
এই রক্তাক্ত ধর্মানুষ্ঠানের বিরুদ্ধেই এক বিপ্লবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আবির্ভাব, যা ছিল অহিংসার এক মহান অভ্যুত্থান। এ দুই ধর্ম একবাক্যে প্রত্যাখ্যান করে দেয় সেই সব আচার-অনুষ্ঠান, যেগুলোর ভিত্তি ছিল পীড়া, হত্যা ও বলিপ্রথা। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মহাবীর—দুজনেই আত্মসংযম, করুণা ও সর্বপ্রাণের প্রতি সদ্ব্যবহারের ওপর জোর দেন।
যজ্ঞে বিপুল পশু বধের প্রতিবাদে বৌদ্ধ ধর্ম অহিংসাকে কেন্দ্রে রেখে এগিয়ে যায় এবং জৈন ধর্ম তো তার পঞ্চ মহাব্রতের প্রথম ব্রতকেই ঘোষণা করে—‘অহিংসা পরম ধর্ম’। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে সম্রাট অশোক তাঁর সাম্রাজ্যে পশু বলি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
(Ashokan Edicts, Rock Edict 1 & 2)

এই দুটি ধর্মের অহিংসানির্ভর নৈতিক শিক্ষা ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে থাকে। ফলস্বরূপ, একসময় হিন্দু ধর্মের বহু সম্প্রদায় নিজেরাই পশু বলির বিরোধিতায় মুখর হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে তারা হয়ে ওঠে পশু বলির সবচেয়ে প্রবল বিরোধী। এই ধর্মীয় নৈতিক রূপান্তর ছিল একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ফল।
ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর, যিনি নিজে একজন হিন্দু সমাজের অন্তর্গত শূদ্র জাতি থেকে উঠে এসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পেছনের রাজনৈতিক কৌশলের দিকটি উন্মোচন করে লেখেন : এটা ছিল ব্রাহ্মণদের এক কৌশলী যুদ্ধনীতি—তারা নিজেদের মাংসাশী স্বভাব লুকিয়ে একসময় গরুপূজারত ব্রাহ্মণ রূপ ধারণ করল। বৌদ্ধদের সাথে চার শ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধের পর অবশেষে করুণার ধ্বজা নিয়ে তারাই জয়লাভ করল। (ওহদত-এ-জদীদ, পৃষ্ঠা-৩৮-৩৯)

মক্কার কাফেদের কোরবানি ও দর্শন
মক্কার মুশরিকরাও কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা পালন করত। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ছিল ভ্রান্ত এবং প্রকৃত ঈমান ও তাওহিদের মর্মবোধ থেকে বঞ্চিত। তারা কোরবানির পশুর গোশত নিজেরাই ভক্ষণ করত এবং তার রক্ত কাবার প্রাচীরে মাখিয়ে দিত, এই বিশ্বাসে যে এভাবেই কোরবানির রক্ত আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যাচ্ছে এবং তাদের কোরবানি কবুল হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা তাদের এই মিথ্যা ও কুসংস্কারপূর্ণ ধারণার কঠোর প্রতিবাদ করেন এবং কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তাদের গোশত কিংবা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : আল-হাজ, আয়াত : ৩৭)

Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে