গত শুক্রবার বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যথাসময়ে হাজির হতে না পেরে এক তরুণ রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করেছেন। আরও কয়েক তরুণ পরীক্ষায় বসতে না পেরে ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন। প্রথম শ্রেণির এই গেজেটেড সরকারি চাকরির মধ্যে আবার সবচেয়ে পছন্দের ক্যাডার প্রশাসন ও পুলিশ। যাঁরা এ বছর এবং এর আগে বিসিএস দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এই শীর্ষ পছন্দের কয়েকটি কারণও জানা গেছে। কারণের মধ্যে রয়েছে—১.নিরাপত্তা, ২. ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, ৩. ক্ষমতা, ৪. সামাজিক মর্যাদা এবং ৫. বাড়তি আয়ের সুযোগ। পুরুষেরা আরও একটি কারণ বলেছেন। আর তা হলো বিয়ের বাজারে বিসিএস কর্মকর্তার চাহিদা সবচেয়ে বেশি পাত্রী পক্ষের কাছে। আসলে বাংলাদেশে স্নাতক তরুণ-তরণীদের মধ্যে এখন বিসিএস কর্মকর্তা হওয়া রীতিমতো স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
গত শুক্রবার ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছে। এ পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করেছিলেন ৩ লাখ ৩৮ হাজার। প্রিলিমিনারিতে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬১ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। পরীক্ষা দেননি ৮৩ হাজার ৪২৫ জন। উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশ। এই বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে মোট পদ ৩ হাজার ১৪০টি। তবে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে।
বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশীরা যা বলছেন
এবার বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। কারণ, আমাদের সামনে এই চাকরিকেই বড় করে দেখানো হয়। আমরা এভাবেই জানছি। আমাদের বিষয়ভিত্তিক পড়ানো শুধু পাস করার জন্য। মূল পড়াশোনা বিসিএস চাকরির জন্য।’ তাঁর মতে, ‘প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেলে ভালো বেতন আছে। ক্ষমতা আছে। সামাজিক মর্যাদা আছে। আছে বেতনের বাইরে আয়ের সুযোগ। বেসরকারি চাকরিতে সেটা নেই।’
রেজাউল করিম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে এখন শিক্ষার্থীরা ব্যাপক পড়াশোনা করেন। কিন্তু কেউ নিজের বিষয় নিয়ে পড়েন না। পড়েন বিসিএস গাইড। আমাদের পড়াশোনা আসলে এখন বিসিএস পড়াশোনা।’
৪৫তম বিসিএসে অংশ নেওয়া মো. মানিক হোসেন রিপন বলেন, ‘বেসরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে। আমরা করোনার সময় দেখেছি, অনেক বেসরকারি চাকরিজীবীর চাকরি চলে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারি চাকরিতে অর্থ আছে। ক্ষমতা আছে। মর্যাদা আছে। প্রশাসন ক্যাডার হলে তো কথাই নেই। আর এখন বিয়ের বাজারে সরকারি চাকরির কদর। বিসিএস ক্যাডার বরের চাহিদা এখন শীর্ষে। বিসিএস চাকরি হলে পছন্দমতো বিয়ে করা যায়।’
মো. মানিক হোসেনের কথায়, ‘বিসিএস অফিসারের যে ক্ষমতা, তাতে চাইলে অনেক ভালো কাজ করতে পারে, খারাপ কাজও করতে পারেন। বেতনের বাইরে অনেক টাকাপয়সা আয়ের সুযোগ আছে।’
এবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আরেকজন আরিফ হোসেন বলেন, ‘আসলে এখানে ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদাই মূল। বাংলাদেশে বিসিএসের বাইরে অন্য পেশায় এটা নেই। আর পাত্রীপক্ষও আগে খোঁজেন বিসিএস পাত্র। বিসিএস না হলে সরকারি চাকরি করে এমন পাত্র। বেসরকারি চাকরিজীবী বা ফ্রিল্যান্সিং করে কেউ মাসে তিন লাখ টাকা আয় করলেও সমাজে তার গুরুত্ব নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো দেখছি ইউএনও, এসপি, ডিসিদের ক্ষমতা। আমরা তো জানি, তাদের কত সুযোগ-সুবিধা। তাহলে আমরা সেটা হতে চাইব না কেন? আর আমাদের পরিবার, বড় ভাই—সবাই বিসিএসের কথা বলেন। আমাদের কাছে তাদের একটাই চাওয়া বিসিএস অফিসার হওয়া।’
রেজাউল করিম, মো. মানিক হোসেন ও আরিফ হোসেনদের ভাষ্য, সবাই মিলে বিসিএসের চাকরিকে মহিমান্বিত করেছে। সংবাদমাধ্যমও বড় করে ছাপে, প্রচার করে বিসিএসে কোন ক্যাডারে কে প্রথম হয়েছে। কোন ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে, তা তো ছাপে না।
কেন এই পরিস্থিতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে শিক্ষা অনেক আগেই তার মূল উদ্দেশ্যের বাইরে চলে গেছে। শিক্ষা হচ্ছে চাকরির জন্য। আর এ সময়ে বিসিএস চাকরির জন্য। আমাদের এখানে এখন আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নেই। হয়ে গেছে পেশিভিত্তিক সমাজ। আর সেটা হলো ক্ষমতা। বিসিএস চাকরি হলো একটা ক্ষমতা। আর প্রশাসন ক্যাডার হলো সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। তাই তরুণেরা সেদিকে যেতেই চেষ্টা করছে।’
মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্র কী চায়, সেটাও দেখতে হবে। সরকার এখন ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা খরচ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একাডেমি তৈরি করছে। এর আদৌ প্রয়োজন নেই। এই প্রশিক্ষণের কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই করতে পারে। ওই টাকা শিক্ষার উন্নয়নে, গবেষণায় কাজে লাগানো যেত।’ তাঁর মতে, ‘এখন রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে ক্যাডারনির্ভার। এখানে জ্ঞানী মানুষ, গবেষক, বিজ্ঞানী গৌণ হয়ে পড়ছে। এর এক ভয়াবহ পরিণতি আমাদের দেখতে হবে। তবে প্রশাসনেও মেধাবীদের দরকার আছে। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, তা হলো ক্ষমতা। আর ক্ষমতা হলে আসে অর্থ। তরুণদের তাই শেখানো হচ্ছে। তাঁরা ইউএনও হবেন, এসপি হবেন, ডিসি হবেন। সবাই তাঁদের স্যার বলবে। তাঁদের সবাই ভয় পাবে। তাঁরা যা কিছু চান, করতে পারবেন। এটাই তাঁদের আদর্শ হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরির ওয়েবসাইট বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আসলে ২০১৫ সালের পে-স্কেলে সরকারি চাকরির বেতন প্রায় দুই গুণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া তাঁদের আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সে রকম বেতন বাড়েনি। সরকার চাইলে আজকেই সরকারি চাকরির বেতন বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় সরকার বেতন দেয়। ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেই সুযোগ নেই। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে অবৈধ উপার্জনের সুযোগ আছে।’
ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আগে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা সরকারি চাকরি করতেন। এখন উচ্চবিত্তের সন্তানেরাও বিসিএস চাকরিতে ঢুকছেন। কারণ, তাঁরা চিন্তা করছেন ক্ষমতা। এখন সরকারি চাকরি একটা ক্ষমতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি খাতে মেধাবীদের সংখ্যা কমছে। এটা এ খাতের জন্য খারাপ খবর।’
বিসিএস ক্যাডারের মধ্যেও আবার বৈষম্য আছে। ফলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রতি তরুণদের আগ্রহ নেই। তাঁরা বিসিএস দিয়ে সরকারি কলেজের শিক্ষক হতে চান না। আবার চিকিৎসা, প্রকৌশলী বিদ্যায় পড়ে ওই ক্যাডারে না গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চান তরুণেরা। একই বেতন, তারপরও কেন প্রশাসন ক্যাডার?
বয়স থাকা পর্যন্ত বারবার বিসিএস দিতে পারেন চাকরিপ্রার্থীরা
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক বলেন, ‘বিসিএস চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ার একটি কারণ হতে পারে যে তারা মনে করে, এখানে যোগ্যতা থাকলে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া যায়। কোনো তদবির বা অন্য কোনো পথ ধরতে হয় না। তবে আরও অনেক কারণ আছে। করোনার সময় অনেক বেসরকারি চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীরা ভালো ছিলেন। এখন সরকারি চাকরিতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভালো। তবে এই কয়েক লাখ যে পরীক্ষা দেন, এর কারণ একজন চাকরিপ্রার্থী বয়স থাকা পর্যন্ত বারবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারেন।’
আবার সরকারি অন্য চাকরি বা বেসরকারি চাকরিতে থেকে কেউ কেউ বয়স থাকা পর্যন্ত বারবার বিসিএস দেন। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যান বিসিএসের জন্য। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫৭ জন সহকারী ও উপপরিচালক চাকরি ছেড়েছেন। কারণ, তাঁরা বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক বলেন, ‘শিক্ষা গবেষণার প্রতি তরুণদের আগ্রহ কমছে। তাঁরা তাঁদের বিষয়ভিত্তিক চাকরির প্রতিও আগ্রহী নন। আমরা দেখেছি, যাঁরা বিসিএস দেন, তাঁদের সর্বশেষ পছন্দ হলো শিক্ষা ক্যাডার। এর কারণ আমাদের এখানে ক্যাডার-বৈষম্য আছে।’
একই বেতন হওয়ার পরও একজন কেন শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক না হয়ে সহকারী সচিব হতে চান? এর কারণ কী? এ প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক বলেন, ‘ওই যে ক্ষমতা। একজন ইউএনও হলেই গাড়ি পান। নানা সুবিধা পান। কিন্তু একজন তো কলেজের অধ্যক্ষ হলেও গাড়ি পান না। একজন অধ্যাপক শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ। কিন্তু তিনি তো থার্ড গ্রেডের। কিন্তু প্রশাসনের একজন সচিব প্রথম গ্রেডের।’